ট্রাম্পের শুল্ক চাপ ও রুশ ঘনিষ্ঠতা: যুক্তরাষ্ট্র-ভারত বাণিজ্য সম্পর্কে উত্তেজনার নতুন অধ্যায়

ছবি সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যকার বাণিজ্যিক সম্পর্কের মাঝে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। চলতি বছরের ৩১ জুলাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ৯০টিরও বেশি দেশের ওপর নতুন শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। এই ঘোষণার মধ্যে ভারতও অন্তর্ভুক্ত। ট্রাম্প প্রশাসনের ভাষায়, এটি একটি “রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ” বা পাল্টা শুল্ক, যার আওতায় ভারতীয় পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক বসানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে ১ আগস্ট থেকে।

ট্রাম্পের এমন আচমকা ঘোষণায় ভারত সরকারের ভেতরে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। এশিয়ার এই বৃহৎ অর্থনীতির দেশটি বহুদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করার চেষ্টা করছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের কিছু বৈদেশিক নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অসন্তোষ ক্রমেই বাড়ছে।

🔥 ট্রাম্পের অভিযোগ: “দুই দিকেই খেলা চলছে”

হোয়াইট হাউস থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে ট্রাম্প সরাসরি বলেন, “ভারত একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবসা করতে চায়, অন্যদিকে রাশিয়া থেকে তেল ও অস্ত্র কিনে আমাদের প্রতিপক্ষকে সহযোগিতা করছে। এই দ্বৈত আচরণ আমরা মেনে নিতে পারি না।” ট্রাম্প আরও অভিযোগ করেন, ভারত চীনের কিছু পণ্য আবার রপ্তানি করে এবং পাকিস্তানের সঙ্গে কিছু সামরিক যোগাযোগ বজায় রাখে, যা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির পরিপন্থী।

ট্রাম্প প্রশাসনের মতে, এই ‘নিষ্পষ্ট অবস্থান’ই যুক্তরাষ্ট্রকে নতুন করে শুল্ক আরোপে বাধ্য করেছে।

💸 পাল্টা শুল্কের খবরে ভারতের উদ্বেগ

ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রক ট্রাম্পের ঘোষণাকে “অপ্রত্যাশিত ও একতরফা” বলে আখ্যা দিয়েছে। ভারতের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই সিদ্ধান্ত ভারতের রপ্তানি খাতকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, বিশেষ করে বস্ত্র, ওষুধ এবং প্রযুক্তিপণ্য খাতে। ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রপ্তানির পরিমাণ ছিল প্রায় ৮৪ বিলিয়ন ডলার।

তবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও প্রতিবাদ জানায়নি। একটি সূত্র বলছে, বিষয়টি নিয়ে ‘আলোচনা ও কূটনৈতিক সমঝোতার’ চেষ্টা চলছে।

🛢️ রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক: সমস্যা কোথায়?

যুক্তরাষ্ট্রের চোখে ভারত-রাশিয়া সম্পর্ক এখন বড় ধাঁধা। বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়ার ওপর ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে পশ্চিমা বিশ্ব। অথচ এই সময়ে রাশিয়ার কাছ থেকে ভারত বিপুল পরিমাণে তেল ও অস্ত্র কিনেছে। ২০২2 সালের পর থেকে ভারতের রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানি বেড়েছে তিনগুণের বেশি।

এ ছাড়া, ভারতের প্রতিরক্ষা খাতের অনেক বড় অংশ এখনো রুশ প্রযুক্তি ও সরঞ্জামের ওপর নির্ভরশীল। মার্কিন প্রশাসনের মতে, এই নির্ভরশীলতা শুধু অর্থনৈতিক নয়, নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও হুমকি হয়ে উঠতে পারে।

⚖️ ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে চাপে ভারত

ভারত অনেক বছর ধরেই একধরনের ‘কৌশলগত ভারসাম্য নীতি’ অনুসরণ করছে—যেখানে একদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও জাপানের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা জোটে থেকেও অন্যদিকে রাশিয়া ও ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখছে। কিন্তু এখন এই নীতি প্রশ্নের মুখে।

বিশেষ করে ট্রাম্পের প্রশাসন এই দ্বৈত কূটনীতিকে আর সহজভাবে নিচ্ছে না। ভারতের চীনবিরোধী অবস্থান এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জোট থাকার পরও রাশিয়া-পাকিস্তানের সঙ্গে গোপন সহযোগিতার অভিযোগ ভারতকে চাপে ফেলেছে।

📉 বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের ওপরও চাপ

শুধু ভারতই নয়, বাংলাদেশসহ অনেক দেশই এই নতুন পাল্টা শুল্কের আওতায় পড়েছে। এপ্রিলে বাংলাদেশের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক ঘোষণা করা হলেও, সেটি পরে কমিয়ে ৩৫ শতাংশ এবং সর্বশেষ জুলাইয়ের শেষে তা আরও কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশের জন্য বাংলাদেশি পণ্যের ওপর আগে থেকেই গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর ছিল, যা এখন আরও বাড়ছে।

এ থেকে স্পষ্ট, ট্রাম্পের ‘লিবারেশন ডে ট্যারিফ’ কেবল একটি নির্দিষ্ট দেশের বিরুদ্ধে নয়, বরং একটি বৃহৎ ভূরাজনৈতিক নীতির অংশ।

🧭 সামনের দিনগুলোতে কী ঘটতে পারে?

বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্প প্রশাসনের এই পদক্ষেপ ভবিষ্যতে একটি বাণিজ্য যুদ্ধের রূপ নিতে পারে। ভারত হয়তো প্রতিক্রিয়া হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়াতে পারে, যেমন—অ্যাপল পণ্য, মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি বা কৃষিপণ্য।

ভারত–যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে “স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ” হিসেবে গড়ে উঠলেও, ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা এবং জাতীয় স্বার্থের দ্বন্দ্বে এখন তা টালমাটাল অবস্থায়।

একদিকে জিও–পলিটিক্স, অন্যদিকে নির্বাচনের বছর—ট্রাম্পের প্রতিটি সিদ্ধান্তেই রাজনৈতিক বার্তা থাকে। বাণিজ্যিক শুল্ক বসানো এখন কেবল অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং একধরনের “রাজনৈতিক অস্ত্র” হয়ে উঠছে। বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যনীতি ও জোট কূটনীতি কীভাবে নতুন রূপ নিচ্ছে, ট্রাম্পের ঘোষণাগুলো তারই এক বাস্তব প্রমাণ।

Post a Comment

Previous Post Next Post