৫ আগস্ট ঢাকায় জনতার দখলে শহর, শেখ হাসিনার পতনের ঘণ্টা

ছবি: সংগৃহীত

একদিকে সরকার ঘোষিত অনির্দিষ্টকালের কারফিউ, অন্যদিকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের একদফা দাবিতে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি—এই দুইয়ের সংঘাতে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সকাল থেকেই থমথমে পরিবেশে ঘুম ভাঙে রাজধানী ঢাকার।

ভোর থেকেই রাজধানীর প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে কাঁটাতারের ব্যারিকেড, পুলিশের চেকপোস্ট আর সেনা সদস্যদের সরব উপস্থিতি জানিয়ে দেয় যে, এই দিনটি সাধারণ কোনো দিন নয়। গুলশান, বনানী, মহাখালী, শাহবাগ, যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুর, রামপুরা—প্রায় প্রতিটি এলাকায় ছিল দমনমূলক তৎপরতা।

সরকার ৪ আগস্ট সন্ধ্যায় সারাদেশে কারফিউ ঘোষণা করলেও, তার আগেই ছাত্রদের আন্দোলনের ঢেউ রাজধানীমুখী হতে শুরু করে। কারফিউ পাশ থাকা স্বত্বেও গণমাধ্যমকর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হয়। আবাসিক এলাকার গলিতেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রহরা ছিল কড়া।

তবুও, সকাল গড়াতেই দৃশ্যপট পাল্টাতে শুরু করে। কারফিউ ভেঙে পথে নামে ছাত্র, তরুণ, নারী-পুরুষ, শিক্ষক-শিক্ষার্থী। কোথাও ফাঁকা গুলি, কোথাও কাঁদানে গ্যাস, তবুও থেমে থাকেনি জনতার মিছিল।

ঢাকার উত্তরা, রামপুরা, বনশ্রী, শাহবাগ—সবখানেই ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ। উত্তরায় সেনা ব্যারিকেড ভেঙে মিছিল এগোয় গণভবনের দিকে। হাতে জাতীয় পতাকা, কাঁধে লাঠি, মুখে ‘দফা এক-দাবি এক, শেখ হাসিনার পদত্যাগ’—এই শ্লোগানে মুখরিত হয় রাজধানী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও শাহবাগেও শিক্ষার্থীদের জড়ো হতে দেখা যায়। সকাল ১০টার পর বিক্ষোভ চরমে পৌঁছায়। পুলিশের টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেডও বাধা হতে পারেনি। বরং, রাস্তায় নামে মায়েরা, বৃদ্ধরা, শিশুরাও।

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের গুঞ্জন। দুপুরে সেনাপ্রধানের ভাষণের আগ মুহূর্তে উত্তেজনা চূড়ান্তে পৌঁছায়। বিকাল ৩টার দিকে গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নিরাপত্তা তুলে নেওয়ার পর দলে দলে মানুষ প্রবেশ করে সেখানে।

গণভবনে ঢুকে ভাঙচুর, লুটপাট এবং মাছ পর্যন্ত নেওয়ার দৃশ্য সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ছাদে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে বিজয় উদযাপন করে বিক্ষোভকারীরা। একই সময়ে জাতীয় সংসদ ভবনে ঢুকে কেউ বসে ছবি তোলেন, কেউ নেন আসবাব।

সেনা সদস্যদের ঘিরে সড়কে সিজদায় লুটিয়ে পড়া, দুই হাত তুলে কান্নারত মানুষের ছবি হয়ে ওঠে এই দিনের প্রতীক। কেউ কেউ বলেন, “আমরা জিতেছি।”

জুলাই-আগস্টের রক্তাক্ত ছাত্র আন্দোলন, কোটা সংস্কার নিয়ে দীর্ঘ আন্দোলনের চূড়ান্ত অভিব্যক্তি যেন হয়ে ওঠে এই ৫ আগস্ট।

দিনের শেষে ঢাকায় ছিল শুধু জনতার মিছিল, নিরাপত্তাহীন শাসকের শূন্য প্রাসাদ আর ইতিহাসের পাতায় লেখা এক নতুন দিন—জনতার জয়, একনায়কতন্ত্রের পতনের চিহ্ন।

Post a Comment

Previous Post Next Post